কান্নায় ভারী ঢাকা মেডিকেল

Physiologist
কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নিহতদের লাশ সনাক্ত করতে স্বজনদের ভিড় লেগে গেছে। নিখোঁজ প্রিয়জনকে খুঁজতে হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আত্মীয়রা। কখনো হাসপাতাল আবার কখনো ভবনটির আশপাশ এলাকায় ছুটছেন স্বজনহারা মানুষ। তাদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চকবাচার ও ঢাকা মেডিকেল এলাকার আকাশ বাতাস। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টা এলাকায় মসজিদের পাশের ওয়াহেদ ম্যানশন নামের পাঁচতলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে লাশের স্তূপ হচ্ছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই চলছে লাশের সন্ধান। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৭০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬৭ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছে। লাশের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। নিহতদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। জানা যায়, সোনিয়া (৩২) ও ছেলে সাহিরকে (৩) নিয়ে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন লালবাগের ডুরি আঙ্গুল লেন এলাকার বাসিন্দা মো. মিঠু (৪০)। বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে স্বজনরা খবর পান, চুড়িহাট্টায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন মিঠু। সেই থেকে এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি তাদের। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুঁটে যান মিঠুর ভায়রা ভাই বাবুল। সারা রাত হাসপাতাল, চকবাজার থানা ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদেরকে জানিয়েও কোনও হদিস মেলেনি পরিবারটির। বৃহস্পতিবার সকালে বাবুল বলেন, কালকে রাতে খবর পাই আমার শ্যালিকার পরিবার নিখোঁজ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি (জরুরি বিভাগ) ও বার্ন ইউনিটে আমরা বার বার খোঁজ নিয়েছি। মিটফোর্ডসহ আশেপাশের অন্য সব হাসপাতালেও লোক পাঠিয়েছি। তাদেরকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাসেল কবীর নামের এক ব্যক্তি দুই ভাতিজাকে খুঁজছেন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট, জরুরি বিভাগসহ মেডিকেলে প্রতিটি জায়গায় খুঁজেন কিন্তু আহত বা দগ্ধদের ভিড়ে দুই ভাতিজা রাজু (৩০) আর মাসুদ রানাকে (৩৫) পাননি। পরে সকাল সাতটায় মেডিকেলে আসা লাশের স্তুপে খুঁজে পান তাদের। রাসেল কবির, ওয়াহেদ ম্যানসনের রানা টেলিকম সার্ভিসের দোকানের ভেতরেই ছিল তারা দুজন। কান্নায় ভেঙে পড়া রাসেল কবীর জানান, দিন পনের আগেই বিয়ে করেন চাঁদনীঘাটের বাসিন্দা রানা। আগুন লাগার সময় দুই ভাই দোকানের ভেতরে ছিলেন। তিনি বলেন, এখন কি বলব নতুন বউটারে, দুই ছেলেই আগুনে পুড়ে মরল, কি বলব আমার ভাই-ভাবীকে। চকবাজারে পারিবারিক ওষুধের ব্যবসা ছিল মঞ্জুর। চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের পাশে ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকে ছিল তার ওষুধের দোকান ‘হায়দার মেডিকো’। চকবাজারেই ইমিটেশন গহনার ব্যবসা ছিল বন্ধু হীরার, আনোয়ারের ছিল ব্যাগের আর নাসিরের ছিল প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবসা। প্রতিদিন কাজ শেষে হায়দার মেডিকোতে এসে বসতেন তারা। একসঙ্গে কিছু সময় গল্প-গুজব করে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতেন। কিন্তু বুধবার রাতে আর নিজ ঘরে ফেলা হলো না নোয়াখালীর চার বন্ধুর। একসঙ্গেই তারা পরপারে পাড়ি দেন। চকবাজারের ভয়াবহ আগুন কেড়ে নিয়েছে তাদের সব গল্প আর স্বপ্ন। চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে পোড়া চারটি মাথার খুলি। মঞ্জুর ভাই লিটন বলেন, বিকেলেই ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়। প্রতি রাতে চার বন্ধু মিলে ফার্মাসিতে আড্ডা দিত। বুধবারও তারা আড্ডায় মিলিত হয়। আগুন লাগার পর তাদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাত তিনটার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে হায়দার মেডিকোর ভেতরে পাওয়া যায় পোড়া চারটি মাথার খুলি। যেহেতু তারা প্রতি রাতে এখানে আড্ডা দিত, সেহেতু চারটি খুলিই বলে দিচ্ছে, এটা তাদের। মর্গের উৎকট গন্ধ, পোড়া লাশের বিভৎসতা-কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রিয়জনদের খুঁজছেন স্বজনরা। লাশের সারি এখন মর্গের ভেতর ছাপিয়ে বারান্দায় চলে এসছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে স্বজনদের ভিড়। কেউ খুঁজছে বন্ধুকে, কেউ ভাইকে, কেউ স্ত্রীকে। লাশের সারি এখন মর্গের ভেতর ছাপিয়ে বারান্দায় চলে এসছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে স্বজনদের ভিড় । কেউ খুঁজছে বন্ধুকে, কেউ ভাইকে, কেউ স্ত্রীকে । কেউ আবার স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মর্গের সামনে। ঢামেক সূত্র জানায়, এখানকার মর্গে মরদেহ রাখার জন্য ২০টি ফ্রিজ আছে। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ১২টি ফ্রিজ নষ্ট। বাকি আটটি ফ্রিজে আগে থেকেই মরদেহ রাখা আছে। মর্গে এত মরদেহ রাখার জায়গা নেই সূত্রটি আরো জানান, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাত থেকে সকাল পর্যন্ত একে একে মরদেহগুলো আসছে। মর্গে মরদেহের স্তূপ জমে গেছে। সংরক্ষণের জায়গা নেই। সংরক্ষণ করতে মর্গের লোকেরা হিমশিম খাচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এতগুলো মরদেহ সংরক্ষণের জায়গা আমাদের কলেজ মর্গে নেই। মর্গে মরদেহ রাখার ফ্রিজ নষ্ট। গত ১৭ ফ্রেরুয়ারি ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমি চিঠিটি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। আশা করি শিগগিরই নষ্ট ফ্রিজগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’ ঢাকা মেডিকেল ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, পুলিশের তৈরি সুরতহাল রিপোর্ট পেলেই আমরা মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত করবো। আগুনে পুড়ে অনেক মরদেহ কালো হয়ে গেছে। বিকৃত মরদেহ চেনা যাচ্ছে না। সেগুলো ডিএনএ পরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।